তিন ফরম্যাটে আবার তিন অধিনায়ক

বাংলাদেশ ক্রিকেট আবারও পুরনো বাঁকে। তিন ফরম্যাটে তিন অধিনায়ক যুগে আবারও প্রবেশ করেছে দেশের ক্রিকেট। নাজমুল হোসেন শান্ত টেস্টে, লিটন দাস টি-টোয়েন্টিতে, আর সদ্য ওয়ানডে দলের দায়িত্ব পেয়েছেন মেহেদী হাসান মিরাজ। এ নিয়ে ২০১৭ ও ২০২১ সালের পর তৃতীয়বারের মতো তিন অধিনায়ক তত্তে¡ ফিরে গেছে বাংলাদেশ। বোর্ডের সিদ্ধান্ত নিয়ে শুরু হয়েছে নানামুখী আলোচনা। কারও মতে, বাইরে থেকে দেখলে সিদ্ধান্তটি যতটা ‘ক্রিকেটীয়’ ভেতরে ঢুকলে বোঝা যায়Ñ এর পেছনে প্রশাসনিক চিন্তা আরও বেশি সক্রিয়। কেউ আবার এটিকে বাস্তবতা বিবর্জিত মনে করছেন।

ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, ভারত- এই ক্রিকেট পরাশক্তিগুলো দীর্ঘদিন ধরেই ফরম্যাটভিত্তিক অধিনায়কত্ব চালু রেখেছে। তারপরও ২০২১ সাল থেকে রোহিত শর্মাই তিন ফরম্যাটে দলকে নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন। সম্প্রতি তিনি টি-টোয়েন্টি ও টেস্ট থেকে অবসর নেওয়ায় এখন আবার তিন ফরম্যাটে তিন অধিনায়ক। তাছাড়া অস্ট্রেলিয়া টি-টোয়েন্টিতে রেখেছে মিচেল মার্শকে। বাকি দুই ফরম্যাটে আবার প্যাট কামিন্স। আবার ইংল্যান্ড রাখছে সু² পরিকল্পনার ছাপ। সাদা বলে এতদিন ছিলেন জশ বাটলার, লাল বলে বেন স্টোকস। এর পেছনে রয়েছে শক্তিশালী ক্রিকেট কাঠামো, বড়সড় স্কোয়াড এবং শতাধিক আন্তর্জাতিক মানের ক্রিকেটার। তারা চাইলেই একটি জাতীয় দলের বাইরে আরও দুটি দল তৈরি করতে পারে, যার প্রতিটিতেই ফরম্যাট স্পেশালিস্ট রাখা সম্ভব। সেখানেই মূল পার্থক্য।

বাংলাদেশের ক্রিকেট কাঠামো এখনো সেই পর্যায়ে পৌঁছায়নি। দেশের ক্রিকেটে এখনো গড়ে ওঠেনি স্থায়ী মানসম্পন্ন পাইপলাইন। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে খেলার যোগ্য ক্রিকেটারের সংখ্যা হাতেগোনা। ২৫ থেকে ৩০ জন ক্রিকেটারকেই ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে খেলানো হয় তিন ফরম্যাটে। একেক ফরম্যাটে বিশেষজ্ঞ তো দূরের কথা, বরং অধিকাংশ খেলোয়াড়ই একাধিক ফরম্যাটে খেলে থাকেন, আর তারাই হয়েছেন অধিনায়ক। এই বাস্তবতায় ফরম্যাটভিত্তিক তিন অধিনায়ক রাখার যৌক্তিকতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে।

নেতৃত্ব ভাগ করে দিলে চাপ কমেÑ এই তত্তে¡র বাস্তব প্রয়োগ দেখা যায় বড় দলগুলোর ক্ষেত্রে। সেখানে একেকজন অধিনায়ক নিজের ফরম্যাট নিয়ে ভাবেন, পরিকল্পনা করেন, ক্রিকেটার বেছে নেন, কৌশল তৈরি করেন। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এই কাঠামো কীভাবে কাজে দেবে, তা নিয়ে শঙ্কা রয়েছে। কারণ তিন অধিনায়কই তিন ফরম্যাটে খেলেন এবং কেউই কোনো একটিতে স্পেশালিস্ট নন। তিনজনের ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি, আলাদা বোঝাপড়া, ভিন্ন নেতৃত্বশৈলী দলের অভ্যন্তরে বিভ্রান্তি তৈরি করতে পারে।

এ ছাড়া প্রত্যেক অধিনায়কের নিজ নিজ জায়গায় প্রতিষ্ঠিত না হওয়াও উদ্বেগের বিষয়। যেমন লিটন দাসের নেতৃত্বে টি-টোয়েন্টি দল সম্প্রতি ব্যর্থ হয়েছে। সিরিজ হেরেছে আইসিসির সহযোগী দেশ আরব আমিরাতের কাছেও। মিরাজ নেতৃত্ব দিয়েছেন শুধু একটিমাত্র সিরিজেই। শান্ত শুরুটা ভালো করলেও ধারাবাহিক হতে পারেননি।

তিন অধিনায়ক ও মিরাজকে বেছে নেওয়ার কারণ জানতে চাইলে বিসিবির ক্রিকেট পরিচালনা বিভাগের চেয়ারম্যান নাজমুল আবেদীন ফাহিম বলেন, ‘বোর্ড মনে করে ব্যাট ও বল হাতে মিরাজের ধারাবাহিক পারফরম্যান্স, দলকে লড়াই করতে অনুপ্রাণিত করার ক্ষমতা এবং মাঠের ভেতরে ও বাইরে তার প্রাণবন্ত উপস্থিতি এই রূপান্তরের সময়ে তাকে ওয়ানডে দলের নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য আদর্শ করে তুলেছে। আমরা বিশ্বাস করি, এই ফরম্যাটে বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য তার মানসিক দৃঢ়তা ও পরিপক্বতা রয়েছে।’

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিসিবির এক কর্মকর্তা বলেন, ‘নতুন সভাপতি এসেছেন বোর্ডে। আসলে বোর্ড যখন নতুন করে গঠিত হয়, তখন অনেক কিছুতেই পরিবর্তন আসে। এ ক্ষেত্রে কখনো কখনো নেতৃত্বেও পরিবর্তন আসে। বোর্ড প্রশাসনিক চাওয়াতে এমন পরিবর্তন আসাটা অস্বাভাবিক না।’

বিসিবির এই উদ্যোগকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন সাবেক অধিনায়ক মোহাম্মদ আশরাফুল, ‘এখন এত বেশি খেলা হয়, ক্রিকেটারদের আসলে বিশ্রাম দেওয়া উচিত। আর সেই ভাবনা থেকেই এমন সিদ্ধান্ত আমার কাছে যুগোপযোগীই মনে হয়েছে। এতে দল সফল হবে বলেই আমি মনে করি।’

তবে আরেক সাবেক অধিনায়ক খালেদ মাসুদ পাইলট বলছেন ভিন্ন সুরে। সোজাসাপটা বলে দিয়েছেন, ‘বাংলাদেশের বাস্তবতা ভিন্ন। আমাদের এত ক্রিকেটার নেই যে আলাদা আলাদা ফরম্যাটে আলাদা দল সাজানো যাবে। তাই তিন অধিনায়কের ভাবনাটা আমার কাছে মনে হয় অকার্যকর। এতে পারফরম্যান্সের আহামরি কোনো পরিবর্তন আসবে বলে মনে হয় না।’

তিন অধিনায়কে ড্রেসিং রুমে বিভক্তি তৈরি হতে পারে কি না? এমন প্রশ্নের জবাব আবার দুজনেই দিয়েছেন একই সুর। দেশ রূপান্তরকে বলেছেন, ‘এখানে কোচ ও টিম ম্যানেজারকে ভ‚মিকা নিতে হবে। তারা যদি অভিভাবকের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করতে পারেন, সব বিষয় যথাসময়ে ক্রিকেট অপারেশনসকে জানান আর ক্রিকেট অপারেশনসও যদি সবকিছু নজরে রাখে তাহলে কোনো সমস্যা হবে না।’

তিন অধিনায়ক রাখার আগে দরকার ছিল তিন ফরম্যাটের অভিজ্ঞ, পরীক্ষিত ও মানসম্পন্ন ক্রিকেটার তৈরি করা। কিন্তু বাস্তবতা বলছে, সেখানে এখনো অনেকটা পথ বাকি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *